এখন বর্ষা কাল। তবুও ঝলমলে রোদ উঠেছে। তাই আজ বেশ খুশি কুলসুম। খুশি হবেইনা কেনো! গ্রামগঞ্জে বৃষ্টি মানেই চারিদিকে পানি আর পানি। এই পরিবেশ দেখতে মনোরম লাগলেও এর মধ্যে থাকাটা হলো যুদ্ধের বিষয়। চারিদিকে সাপের উপদ্রপ। এইজন্য কতো মানুষ মারা যায় এই বর্ষা কালে! শুধু কি মানুষ? হাস মুরগী গুলোও রেহায় পায়না। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের কতো কষ্ট হয় এতে তা তো কুলসুম ভালো ভাবেই জানে। আর কেনোই বা জানবেনা। সে তো নিজেই এসবের সম্মুখীন হয়েছে কতোবার। শহরের মেয়ে হলে হয়ত এই চৌদ্দ বছরের বয়সে সে এসবের কিছুই বুঝতো না। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের কথাটা অন্যরকম। তারা এতো আদরের দুলালী হয়না। তারা ছোটোবেলা থেকেই সব বোঝে। অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ছোট্ট কুলসুমের বৃষ্টি আবার খুব পছন্দ। কিন্তু সাপে তার খুব ভয়। এই পরশু দিনই তো তার আব্বা মোক্তার মিয়া ইট দিয়ে বাধানো পোটির ভেতর থেকে তিনটা সাপ মারলো। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে কুলসুমের। তার তো আজকাল ঘুমোতেও ভয় করে। তাই রোদ্রজ্বল দিনই ভালো এখন তার জন্য। কুলসুম মনে মনে ভাবে যে একদিন তার এক রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হবে। তখন আর এই গ্রামের ভাঙা ঘরে এতো ভয় নিয়ে থাকতে হবেনা তার। ইটপাথরের উঁচু প্রাসাদ বাড়িতে সে খুব মজা করে সারা বর্ষার বৃষ্টি উপভোগ করবে।
কুলসুমরা তিন ভাই বোন। এদের মধ্যে কুলসুমই বড়। ভাই দুটো ছোটো। বড়টার নাম মনিরুল আর ছোটোটার নাম আনারুল। কুলসুমের আব্বা মোক্তার মিয়া অসুস্থ মানুষ। তেমন কোনো কাজ করেন না। সংসার টা কোনো রকম চলে যায় তাদের বড়লোক আত্মীয়দের দান আর যাকাতের টাকা দিয়েই। আর মা কমলা বেগম হাস মুরগী পালেন। একটু আকটু মাছের চাষও করেন। এই দিয়ে খুবই অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে চলে যায় তাদের পাঁচ জনের সংসার।
“এই কুলসুম ইস্কুলে যাবি ককুন?” কমলা বেগম কাজের ফাঁকে বলে উঠলেন।
“হয় মা যামুগা এখনই। আব্বা কই দেখতাছি নাতো!”
“তোর আব্বা একটু শহরে গেছেগা। তুই ইস্কুলে যাগা।”
“আইচ্ছা যায়।”
কুলসম আরো খুশি হয়ে উঠলো। মা কিছু না বললেও সে জানে যে আব্বা শহরে যায় টাকা আনতে। আর মাঝে মাঝে তো ওরা ওদের কিছু পুরাতন কাপড় চোপড়ও দিয়ে দেয়। পুরাতন হলে কি হবে কুলসুমের ওগুলো নতুনই মনে হয়। খুশি মনে স্কুলের পথে রওনা হলো সে।
কুলসুম স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে কমলা বেগম কাঁদছেন আর শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শহরে মোক্তার মিয়া হাসপাতালে ভর্তি। আসার সময় নাকি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে তার। কুলসুমও কান্নায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু মায়ের সাথে শহরে যাওয়ার জিদ ধরলো না। কারণ আব্বা আর মা বাসায় না থাকলে পুরো বাড়িটা আর তার ছোটো ভাই দুটোকে যে তারই সামলাতে হবে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। কুলসুমের চোখে ঘুম নেই। না জানি আব্বাটা কেমন আছেন। বৃষ্টিটাও আবার শুরু হয়েছে সেই কখন। কুলসুম জানালা দরজা সব বন্ধ করে দিয়েছে। রান্নাটাও আজ সেই করেছে। ওরা তিনজনই খেয়ে নিয়েছে। ভাই দুটো সেই কখন ঘুমিয়েও গিয়েছে। এখন কুলসুমের চোখও আস্তে আস্তে ঘুমে ভারি হওয়া শুরু করেছে।
মোক্তার মিয়ার বাস আরেক বাসের সাথে সংঘর্ষ করে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন দ্রুত অপারেশন করা লাগবে। এর জন্য প্রায় চার লাখ টাকার দরকার। এতো টাকা কে দিবে এখন। স্বামীকে কিভাবে বাঁচাবেন এই ভেবে কমলা বেগম কেঁদে কেটে অস্থির। তাদের পরিবারের জমা সব মিলিয়ে বিশ হাজারের বেশী হবেনা। সব আত্মীয়রা দিলেও বা কতো দিবে এই সল্প সময়ে। এতো টাকা তারা এখন কোথায় পাবেন। এসবের মধ্যে কুলসুমরা কি করছে কি খাচ্ছে এসব চিন্তাও মাথায় আসছেনা কমলা বেগমের। সবার কাছে হাত পেতেও কোনো লাভ হলোনা। অনেকেই কিছু না কিছু দিয়েছে কিন্তু এতো টাকা কে দিবে?
লেখিকা: সানজিদা সালাম আনিকা, ছাত্রী